“ঈদে মিলাদুন্নবী” কি এবং কিভাবে মিলাদুন্নবী সৃষ্টি হলো? (১ম পর্ব)
ধর্ম ডেস্ক : ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উপমহাদেশে একটি বেশ আলোচিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের মুসলিমরা খুব ঘটা করে ১২ই রবিউল আউয়াল নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর জন্মদিন হিসাবে “ঈদে মিলাদুন্নবী” পালন করে থাকে। অথচ নবী(ﷺ) এরও এই ‘ঈদের’(!) কথা জানা ছিল না। শুধু তাই নয়, এই ‘ঈদের’(!) কথা জানা ছিল না সাহাবী, তাবিঈ, তাবে-তাবিঈ কারোই। তাহলে কোত্থেকে এলো এই ‘ঈদ’ ?
‘ভয়েস অব পিপল‘ সব সময় জনগনকে ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানুষ, সমাজ, জীবন ইত্যাদি সব বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি একটি গণমাধ্যমের মূল কাজই হচ্ছে জনগনকে নানা বিষয়ে সচেতন করে তোলা। আর সেই লক্ষ্যেই আমাদের আজকের এ লেখা।
আসুন আমরা রেফারেন্সসহ ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে কিছু জানতে সচেষ্ট হই। আমরা এ নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করবো ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে কি বোঝায়, কিভাবে ঈদে মিলাদুন্নবীর সৃষ্টি হলো, একজন মুসলিমের মিলাদুন্নবী পালন করা কতটা যৌক্তিক? আসুন গভীর মনযোগ দিয়ে আমরা এসব তথ্য জানতে সচেষ্ট হই।
ঈদে মিলাদুন্নবীর সংজ্ঞা:
‘জন্মের সময়কাল’কে আরবীতে ‘মিলাদ’ বা ‘মাওলিদ’ বলা হয়। সেই হিসাবে ‘মিলাদুন্নবী’-র অর্থ দাঁড়ায় ‘নবীর জন্ম মুহূর্ত’। নবীর জন্মের বিবরণ, কিছু ওয়ায ও নবীর রূহের আগমন কল্পনা করে তার সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নাবী সালামু আলায়কা’ বলা ও সবশেষে জিলাপী বিতরণ- এই সব মিলিয়ে ‘মিলাদ মাহফিল’ ইসলাম প্রবর্তিত ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহা’ নামক দু’টি বার্ষিক ঈদ উৎসবের বাইরে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ নামে তৃতীয় আরেকটি ধর্মীয়(?) অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎপত্তি :
ক্রসেড বিজেতা মিসরের সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হিঃ) কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম কারো মতে ৬০৪ হিঃ ও কারো মতে ৬২৫ হিজরীতে মিলাদের প্রচলন ঘটান রাসূলের মৃত্যুর ৫৯৩ বা ৬১৪ বছর পরে। এই দিন তারা মিলাদুন্নবী উদযাপনের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হ’তেন। গভর্ণর নিজে তাতে অংশ নিতেন। আর এই অনুষ্ঠানের সমর্থনে তৎকালীন আলেম সমাজের মধ্যে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন আবুল খাত্ত্বাব ওমর বিন দেহিইয়াহ (৫৪৪-৬৩৩ হিঃ)। তিনি মিলাদের সমর্থনে বহু জাল ও বানাওয়াট হাদিস জমা করেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী হুকুম :
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন একটি সুস্পষ্ট বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।
তিনি আরো বলেন,وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে সাবধান থাক। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত ও প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী’।[3] জাবের (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম’।
ইমাম মালেক (রহঃ) স্বীয় ছাত্র ইমাম শাফেঈকে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের সময়ে যেসব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমান কালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না। যে ব্যক্তি ধর্মের নামে ইসলামে কোন নতুন প্রথা চালু করল, অতঃপর তাকে ভাল কাজ বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বলে রায় দিল, সে ধারণা করে নিল যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন’।
মিলাদ বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের ঐক্যমত :
‘আল-ক্বাওলুল মু‘তামাদ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, চার মাযহাবের সেরা বিদ্বানগণ সর্বসম্মতভাবে প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠান বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাঁরা বলেন, এরবলের গভর্ণর কুকুবুরী এই বিদ‘আতের হোতা। তিনি তার আমলের আলেমদেরকে মিলাদের পক্ষে মিথ্যা হাদিস তৈরী করার ও ভিত্তিহীন ক্বিয়াস করার হুকুম জারী করেছিলেন।
উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে কি বলেন :
মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খ আহমাদ সারহিন্দী, আল্লামা হায়াত সিন্ধী, রশীদ আহমাদ গাংগোহী, আশরাফ আলী থানভী, মাহমূদুল হাসান দেউবন্দী, আহমাদ আলী সাহারানপুরী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম ছাড়াও আহলেহাদীস বিদ্বানগণ সকলে এক বাক্যে প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠানকে বিদ‘আত ও গুনাহের কাজ বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুদিবসে জন্মবার্ষিকী :
জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঠিক জন্মদিবস হয় ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার। ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ছিল তাঁর মৃত্যুদিবস। অথচ ১২ রবিউল আউয়াল রাসূলের মৃত্যুদিবসেই তাঁর জন্মবার্ষিকী বা ‘মিলাদুন্নবী’র অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
একটি সাফাই :
মিলাদ উদযাপনকারীরা বলে থাকেন যে, মিলাদ বিদ‘আত হ’লেও তা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’। অতএব জায়েয তো বটেই বরং করলে সওয়াব আছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষকে কিছু বক্তব্য শুনানো যায়। উত্তরে বলা চলে যে, সালাত আদায় করার সময় পবিত্র দেহ-পোষাক, স্বচ্ছ নিয়ত সবই থাকা স্বত্তেও সালাতের স্থানটি যদি কবরস্থান হয়, তাহ’লে সে সালাত কবুলযোগ্য হয় না। কারণ এরূপ স্থানে সালাত আদায় করতে আল্লাহর নবী (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। রাসূল (সাঃ)-এর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সালাত আদায়ে কোন ফায়দা হবে না।
তেমনি বিদ‘আতী অনুষ্ঠান করে নেকী অর্জনের স্বপ্ন দেখা অসম্ভব। হাড়ি ভর্তি গো-চেনায় এক কাপ দুধ ঢাললে যেমন পানযোগ্য থাকে না, তেমনি সৎ আমলের মধ্যে সামান্য শিরক-বিদ‘আত সমস্ত আমলকে বরবাদ করে দেয়। সেখানে বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দুই ভাগে ভাগ করা যে আরেকটি গোমরাহী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাকি অংশ পড়ার জন্য পরবর্তী অধ্যায় দেখুন