শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জরুরি

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জরুরি

মো. ইব্রাহীম প্রামানিক

সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকের মধ্যেই অসচেতনতা আছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও এর ব্যতিক্রম নন। শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা ও ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই। এমনকি ক্লাসে হঠাৎ অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে নানা ধরনের মানসিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। সে ক্ষেত্রে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরামর্শ দপ্তর ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থাকাটা জরুরি।

দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, শিক্ষা কার্যক্রমের চাপে হতাশা ও সেশনজট ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাদের মধ্যে ক্রমাগতই বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আত্মহত্যার কারণের মধ্যে বেশ কিছু উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। তার মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৪.৭৫ শতাংশ। পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ। আর্থিক সমস্যায় ৪.৯৫ শতাংশ। পড়াশোনা-সংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ শতাংশ। মাদকাসক্ত হয়ে ১.৯৮ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। তাছাড়া মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার একটি লেখা পড়ে বোঝাই যায়, তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই নশ্বর জগৎ থেকে মৃত্যুর জগতটাই একমাত্র সুখের। সুতরাং সঠিক কাউন্সিলিংয়ের অভাবে আত্মসংযম, ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে না জানার কারণেই মৃত্যুকেই তিনি সুখের ও মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কাজেই বলা যায়, শিক্ষাজীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪০৪টি। তাছাড়া দেশের ৩৮টি সরকারি, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১ হাজার ৬৪০ জন জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ ও ৫৬ শতাংশ। প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছেন। করোনা পরবর্তী পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক চাপ, অর্থনৈতিক সমস্যা প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এমনটিই উঠে এসেছে আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে।

এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ড. মো. মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির অভাব। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা ও ছাত্র পরামর্শ কেন্দ্র থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোগে যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে মেডিকেল সেন্টার সংকট ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে ভুগছেন লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। অনেকে আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। এছাড়া কাউন্সেলিংয়ের অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। এত সমস্যা ঘিরে থাকলেও এ বিষয়ে নেই কোনো উপযুক্ত সেবা ও পরিবেশ। এমনকি এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ মিলছে না।

দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সেন্টারের ভবন থাকলেও সেবা নিয়ে হাজারও প্রশ্ন জমে আছে শিক্ষার্থীদের মনে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র একজন চিকিৎসক দিয়ে মেডিকেল সেন্টার পরিচালনা করা হলেও মেলে না সেবা, ওষুধ বা জরুরি পরামর্শ। এমন অনিয়ম প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই। ‘স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক মাহমুদ হোসেন বলেছেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার নিশ্চিত করা জরুরি। মেডিকেল সেন্টারের প্রাথমিক সেবা এবং ইউনিভার্সিটি চলাকালীন চিকিৎসক নিশ্চিত করতে না পারলে অনেক সময় অপ্রত্যাশিত ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। তাছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর জরুরি ভিত্তিতে পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সেন্টার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। 

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মেডিকেল সেন্টার, ছাত্র পরামর্শ কেন্দ্র ও চিকিৎসক নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরামর্শ কেন্দ্র ও সুস্বাস্থ্যের জন্য মেডিকেল সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মানসিক চর্চা, ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। এমনকি ক্যারিয়ারবিষয়ক দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতি (ডিআইইউসাস)।