সমাজ

‘হিট অফিসার’ নিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কারণ

‘হিট অফিসার’ নিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কারণ

হেলাল মহিউদ্দীন

দুনিয়াজুড়ে বিচিত্র পেশাগত পদবি আছে। শুনলে মনে হবে ‘তওবা– এ রকম পদবিও থাকা সম্ভব?’ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এমন অনেক পদ-পদবি আছে, যেগুলো নিয়ে কর্মরতরাই হাসি-ঠাট্টা করতে ছাড়েন না। যেমন– চিফ গিক (প্রধান ঘেঁটু), প্যারানয়েড-ইন-চিফ (প্রধান ভুলধরা-বাতিকগ্রস্ত), এম্পেরর অব বিট-ল্যান্ড (বিট-রাজ্যের সম্রাট), সফটওয়্যার নিঞ্জানিয়ার বা ‘নিনজা’ ইঞ্জিনিয়ার। গুগলের প্রযুক্তি বিভাগের শীর্ষ পরিচালকের পদবি ‘সিকিউরিটি প্রিন্সেস’ (নিরাপত্তা রাজকন্যা)। প্রিন্সেস পদবির কারণে তাঁর নারী হওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘সিকিউরিটি’ শব্দের কারণে লাঠি বা বন্দুক হাতেও পাহারা দিতে হয় না। পুরুষ মানুষ প্রিন্সেস? হ্যাঁ, ঠিক তাই! সব বিষয়কে সব সময় আক্ষরিক অর্থে নিতে হয় না।  সে অর্থে ‘চিফ হিট অফিসার’ অনেকটাই স্বাভাবিক পদবি। বাংলাদেশে এই প্রথম এই পদে একজনকে নিয়োগ দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ঘটনাক্রমে তিনি ওই এলাকার বর্তমান মেয়রের কন্যা। তাঁর নাম বুশরা আফরীন।

অনেক বাংলাদেশি ‘চিফ হিট অফিসার’ পদটির নাম প্রথম শুনেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছেন– বিশ্বের আর কোথাও এ রকম কিছু নেই। কথা উঠেছে নিয়োগপ্রাপ্তের পড়াশোনা উন্নয়নশাস্ত্রে; আবহাওয়াবিজ্ঞানে নয়। এটি বোঝার ভুল। আবহাওয়াবিজ্ঞান, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, উন্নয়ন পাঠ– সবই সম্পর্কিত বিষয়। বর্তমান সময়ে উন্নয়নবিদ্যা বহু বিষয়ভিত্তিক তথা মাল্টিডিসিপ্লিনারি এবং প্রায়োগিক। উন্নয়ন বিষয়ে পাঠ নিতে গেলে পরিবেশবিদ্যা-আবহাওয়াবিদ্যার পাঠও নিতে হয়। সে বিবেচনায় তাঁর উচ্চতর ডিগ্রিকে পদের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ মনে করার সুযোগ কম। 

নেটিজেনদের মধ্যে বুশরা আফরীনের পক্ষ-বিপক্ষে মোটাদাগে তিনটি মনোভাব স্পষ্ট। এক. ‘চিফ হিট অফিসার’ কীভাবে তীব্র তাপদাহ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন? বেশিরভাগেরই সন্দেহ– কাজের কাজ কিছুই হবে না। অবিশ্বাস থেকে নানা সম্পূরক প্রশ্ন উঠেছে। দুই. সাধারণ্যে গভীর সন্দেহ– ঢাকা উত্তরের মেয়র নিজ কন্যাকে নিজের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতেই এই বানোয়াট পদ তৈরি করেছেন। প্রশ্ন ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কর্তৃপক্ষ বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির না করায় স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সন্দেহ জোরদার হয়েছে। তিন. নিয়োগের বেলায় দক্ষতা-যোগ্যতা মানা হয়নি; দেওয়া হয়নি বিজ্ঞাপন; প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়নি; নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিয়ম-নীতি-নৈতিকতা অস্বচ্ছ ইত্যাদি অনুমানেই তাঁরা থিতু থাকছেন।

একটি সময়ে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নিয়োগটির যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, বিদেশি সংস্থার তত্ত্বাবধানে তাঁর নিয়োগ এবং অর্থায়ন হয়েছে। অন্যপক্ষ বলছে, মেয়রকন্যার বেতন ধরা হয়েছে মাসিক ৮ লাখ টাকার মতো। বিদেশি সংস্থার তত্ত্বাবধানে নিয়োগ ও কাজের সমন্বয় হলেও অর্থায়ন নগর কর্তৃপক্ষই করবে। নগর কর্তৃপক্ষ চটজলদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে দিলে ধোঁয়াশা কাটত। জবাবদিহি শুধু কাম্যই নয়; জনগণের তথ্যের অধিকারও বটে। বিষয়টি দ্রুত খোলাসা করে দিলে অস্বস্তিকর ও অশালীন আলাপ বাড়ত না। আশা করা যায়, নগর কর্তৃপক্ষ জবাবদিহির ব্যবস্থা করবে। প্রশ্ন ধরে ধরে উত্তরও দেবে।     

২.

দুনিয়াজুড়ে কোটি কোটি মানুষ চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছেন। এ দেশেও হাজার হাজার পদে নিয়োগ থেমে নেই। সেগুলো নিয়ে কি হইচই হয়? গত দশ-কুড়ি বছরে দেশ-বিদেশে কয়টি নিয়োগের বিপরীতে হইচই হয়েছে? দেশে সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের মচ্ছবের পেছনে সমুদ্রসমান অনিয়ম-অপরাধ, ঘুষ বাণিজ্য-দুর্নীতি একেবারে ‘ওপেন সিক্রেট’। সেগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দরকারি আলোচনার ১ শতাংশ দেখা গেলেও দেশটি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নীতিনৈতিকতার দাবিতে সরগরম থাকত। বরং সত্য হচ্ছে, এ দেশের জনগণ নিয়োগ দুর্নীতিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিতেই বেশি অভ্যস্ত। মেয়রকন্যার নিয়োগের পর যাঁদের প্রতিবাদ ও টিপ্পনীতে মত্ত দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ক’জনই বা বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন– তাঁরা দক্ষতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় স্বচ্ছতার সঙ্গেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন! তবু স্বীকার করে নিতে হয়, গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবি তোলার অধিকার সবারই রয়েছে। একজন অসৎ ব্যক্তি নিজে অসৎ হয়েও চাইতে পারেন আর কেউ যেন অসৎ না হন; অসততার শিকার না হন। সে বিচারে জনপ্রতিক্রিয়া দরকারিও বটে। তাতে অন্তত বোঝা যায়, মানুষ দেখছে, বুঝছে এবং অসাবধানীকে সাবধান হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জনমতের কারণেই অশুদ্ধজন বিশুদ্ধ না হলেও খানিকটা শুদ্ধ হতে বাধ্য হন।        

দু-চারটি নিয়োগের বেলায় ছিটেফোঁটা কিছু প্রশ্ন যে ওঠেনি, তা নয়। কিন্তু সেগুলোর পরিসর ছিল নিতান্তই সীমিত। আলোচনাও হতো ফিসফাস ধরনের। গত এক-দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের কয়েকজন অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যে শীর্ষে আছেন। কয়েকজন উপাচার্য অযোগ্য সন্তানদের নানা কলাকৌশলে শিক্ষক বানিয়ে বসেছেন। আত্মীয়স্বজন ও নিকটজনের এই পদে সেই পদে বসিয়ে গেছেন। শিক্ষাঙ্গন ছাড়া সেগুলো বাইরের দুনিয়ায় অজ্ঞাতই থেকে যায়। সেসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সরব প্রতিবাদ দেখেছি কি? উত্তর– না! কারণ কী? এবারের মতো প্রতিক্রিয়া কখনোই হলো না কেন? সহজ উত্তর– উপাচার্যরা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না।

নাগরিকরা জনপ্রতিনিধিদের চোখে চোখে রাখে। তাঁদের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রত্যাশা করে। তাঁদের দ্বারা কোনো বাজে উদাহরণ তৈরি হোক, তেমনটি চায় না। সেই কারণেই কয়েক বছর আগে অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশনের একজন জনপ্রিয় মেয়রও নিজ সন্তানকে সিটি করপোরেশনে নিয়োগ দিয়ে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিলেন। তাঁর বেলায়ও সমালোচনার মাত্রা উপাচার্য-সন্তানদের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতির সমালোচনার চেয়ে বহু গুণ ছিল। কারণ তিনি জনপ্রতিনিধি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

৩.

আলোচিত নিয়োগটির শুরুতে যা ছিল হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপে সীমাবদ্ধ, দ্রুতই তা সারাদেশে একটি জাতীয় পর্যায়ে গণপ্রতিক্রিয়ার রূপ নিল কেন? গণপ্রতিক্রিয়া ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে শালীনতা ছাড়াতে শুরু করল কেন? এ রকম অস্বাভাবিক জনপ্রতিক্রিয়া কী দেখায় ও শেখায়? দেখা দরকার প্রতিক্রিয়াগুলো আসলে কীসের ইঙ্গিত!

প্রথম ইঙ্গিত, ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত নাগরিকদের ক্ষোভ ক্ষমতার রাজনীতি বিষয়ে তীব্র অবিশ্বাসে রূপ নিয়েছে। অক্ষমতার চাপা ক্রোধ সুযোগ পেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ইস্যু ঘিরে ফেটে পড়ছে। একে বলা যায় অক্ষমের আক্রোশ। নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রকন্যা বলেই গণ-উষ্মার শিকার হয়েছেন– ধারণাটি ঠিক নয়। মেয়রকন্যার নিয়োগ ঠিক কি বেঠিক, স্বচ্ছ কি অস্বচ্ছ– সেই মূল্যায়ন বা রায় দেওয়ার জন্য লেখাটি নয়। আলোচনার খাতিরে ধরে নেওয়া ভালো– সবই ঠিকঠাক নিয়ম মেনেই হয়েছে। জনতা অজ্ঞতাবশত প্রথমে সন্দেহ করেছে এবং পরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে দেশময় হৈ-হল্লা ছড়িয়েছে। তারা যত প্রশ্ন তুলেছে তার সব উত্তর নিশ্চয়ই আছে। ঢাকা উত্তর নগর কর্তৃপক্ষ উত্তর দিতেও পিছপা হবে না, আশা করা যায়।

জনপ্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত– আম জনতা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। সভ্য দুনিয়ায় নিয়োগের বেলায় এটা প্রথম বিবেচ্য। মেয়রকন্যা কানাডায় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে পাঠ নিয়েছেন। সে দেশেও যে কোনো নিয়োগে ‘স্বার্থের সংঘাত’ না থাকা প্রথম শর্ত। উন্নয়ন-সমাজবিজ্ঞানে বিষয়টি সিলেবাসেরও অংশ। মেয়রকন্যা পদটির জন্য সবচেয়ে যোগ্য ও উপযুক্ত হলেও তাঁর দরকার ছিল পদটি প্রত্যাখ্যান করা। কারণ, তাঁর পিতাই নগরপ্রধান। নগরপ্রধানও কন্যাকে বলতে পারতেন– তুমি যোগ্যতম হলেও নিয়োগটিতে স্পষ্ট ‘স্বার্থের সংঘাত’ রয়েছে। দু’জনের কেউই বিষয়টির তোয়াক্কা করলেন না? বিষয়টি বেআইনি না হলেও ঠিক নৈতিক হয়নি। ব্যাপক জনপ্রতিক্রিয়া আসলে তাদের ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ নীতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে জনতার ‘না’ ভোট মাত্র!

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়