মিয়ানমার পরিদর্শনে গিয়ে যা দেখল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দল

মিয়ানমার পরিদর্শনে গিয়ে যা দেখল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দল
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সাথে কথা বলছেন মিয়ানমারের কর্মকর্তারা - ছবি : বিবিসি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ হিসেবে শুক্রবার সকালে মিয়ানমারের কিছু এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হয় কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ২০ জনের একটি দলকে। সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য মিয়ানমার সরকার যে অবকাঠামো তৈরি করছে, সেগুলো পরিদর্শন করে তারা।

পরে দুপুরে টেকনাফে ফিরে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তারা সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে। ফেরত আসার পর ২০ জনের দলের অধিকাংশ রোহিঙ্গাই বলেন তারা এ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান না। 

২০ জনের ওই দলের একজন সদস্য সৈয়দ আলমের সাথে কথা হয়। আলম ব্যাখ্যা করেন কেন প্রত্যাবাসনের প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়ে ভরসা পাচ্ছেন না তিনি।

‘সারাজীবন ক্যাম্পে থাকতে হবে’
রোহিঙ্গাদের ২০ জনের দলটিকে শুক্রবার সকালে একটি ট্রলারে করে টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের নাগপুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় তাদের সাথে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন।

নাগপুরা থেকে একটি গাড়িতে করে তাদের নেয়া হয় মংডু এলাকার বলিবাজার ক্যাম্পে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সৈয়দ আলম বলেন, বলিবাজারে যে ক্যাম্পে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে প্রায় সাড়ে এগারোশো মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সৈয়দ আলম বলেন, ‘ওই ক্যাম্পে মোট ১ হাজার ১৪৭ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। সেখানে ঘরগুলো দোতলা, টিন দিয়ে তৈরি। একেকটা ঘরের দৈর্ঘ্য আট থেকে ১২ হাত।’ 

তিনি বলেন, দোতলা বাসাগুলোর প্রত্যেকটিতে রান্নাঘরসহ তিনটি রুম রয়েছে। প্রতিটি বাসায় চার-পাঁচজনের একটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ক্যাম্প এলাকায় বসতবাড়ি ছাড়াও কয়েকটি মসজিদ ও স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সৈয়দ আলম বলেন, বলিবাজার ক্যাম্প বাদে তাদের আরো দুটি ক্যাম্প ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। ওই ক্যাম্পগুলোও দেখতে অনেকটা একইরকম, তবে আয়তনে বলিবাজার ক্যাম্পের চেয়ে কিছুটা ছোট।

বসবাসের সুব্যবস্থা থাকলেও সেখানে তাদের যেসব নিয়ম মেনে চলতে হবে, তাতে তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা থাকবে না বলে মনে করেন আলম।

‘ক্যাম্প থেকে বের হতে হলে আমাদের বিশেষ একটি অনুমতিপত্র নিতে হবে। ক্যাম্প এলাকার বাইরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বের হতে দেয়া হবে। নির্দিষ্ট সময় শেষে আবার ক্যাম্পেই ফিরতে হবে।’

তার ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়েও নিশ্চিতভাবে কিছু জানানো হয়নি তাদের।

‘সেখানে যাওয়ার পর আমাদের প্রথমে এমপিসি (মিয়ানমার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স) নিতে হবে। তারপর আমরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবো। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর ক্যাম্পের বাইরে অন্য এলাকায় আমরা জমি কিনতে পারবো, কারণ তারা আমাদের আগের জমিজমা, সম্পদ ফেরত দেবে না। আর সেটি না করলে আমাদের সারাজীবন ক্যাম্পেই থাকতে হবে।’

নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কতদিনের মধ্যে তারা মিয়ানমারের নাগরিক হবেন বা আদৌ হবেন কিনা, সেবিষয়ে তাদের পরিষ্কার করে কিছু জানানো হয়নি বলে বলছিলেন সৈয়দ আলম।

কর্তৃপক্ষ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে 'আশাবাদী'
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট না হলেও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের কার্যক্রম ও পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।

রোহিঙ্গাদের যে দলটি শুক্রবার মিয়ানমার সফর করে, তাদের সাথে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান ছিলেন। তিনি বলছিলেন মিয়ানমারের মংডু অঞ্চল ঘুরে সেখানকার পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূলে মনে হয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের।

‘আমরা মংডু শহর ঘুরে দেখেছি অনেক রোহিঙ্গা সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। অনেক রোহিঙ্গাই সেখানে ভালোভাবেই বসবাস করছে।’

প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের অসন্তোষের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মন্তব্য করেন‘দুই-একজনের মনোভাব’ ভিন্ন হতে পারে।

‘৬০ থেকে ৭০ বছরে যে সমস্যা সমাধান হয়নি, তা একদিন-দু‘দিনে সমাধান হবে না। আমরা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।’

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা এখন কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য বলে জানান শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

মিজানুর রহমান জানান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির সফর করবেন। ওই প্রতিনিধি দলও রোহিঙ্গাদের মধ্যে থাকা উদ্বেগ দূর করে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাজি করার চেষ্টা করবেন।

প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি কতটা
২০১৭ সালে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে পালিয়ে আসার পর থেকে তাদের মিয়ানমারের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাবাসিত হয়নি।

প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তালিকা নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির পর গত বছরের জানুয়ারিতে একটি পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা অনুমোদন দেয় মিয়ানমার।

সেই তালিকার ৭১১ জনকে প্রত্যাবাসনের সম্মতি দেয়া হয় আর বাকি ৪২৯ জনের তথ্য যাচাই করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে মার্চ মাসে।

সেই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি দল মিয়ানমারের কয়েকটি এলাকা সফর করতে যায়।

শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের এবারের পদক্ষেপ একটি ‘আইওয়াশ’ মাত্র।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা, চীনের পক্ষ থেকে চাপের মত নানা কারণে মিয়ানমার ‘লোক দেখানো’ এই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

সূত্র : বিবিসি