ঈদে মিলাদুন্নবী কি এবং কিভাবে মিলাদুন্নবীর সৃষ্টি হলো? (২য় পর্ব)

ক্বিয়াম প্রথা :

সপ্তম শতাব্দী হিজরীতে মিলাদ প্রথা চালু হওয়ার প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে আল্লামা তাক্বিউদ্দীন সুবকী (৬৮৩-৭৫৬ হিঃ) কর্তৃক ক্বিয়াম প্রথার প্রচলন ঘটে বলে কথিত আছে।[6] তবে এর সঠিক তারিখ ও আবিষ্কর্তার নাম জানা যায় না।

উপমহাদেশে দু’ধরনের মিলাদ চালু আছে। একটি ক্বিয়ামযুক্ত, অন্যটি ক্বিয়াম বিহীন। ক্বিয়ামকারীদের যুক্তি হ’ল, তারা রাসূলের ‘সম্মানে’ উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর দ্বারা তাদের ধারণা যদি এই হয় যে, মিলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তবে এই ধারণা সর্বসম্মতভাবে কুফরী। হানাফী মাযহাবের কিতাব ‘ফাতাওয়া বাযযারিয়া’তে বলা হয়েছে,مَنْ ظَنَّ أنَّ أرواحَ الأمواتِ  حاضرةٌ نَعْلَمُ يَكْفُرُ-  ‘যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহ হাযির হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি কাফের’।

অনুরূপভাবে ‘তুহফাতুল কুযাত’ কিতাবে বলা হয়েছে, ‘যারা ধারণা করে যে, মীলাদের মজলিসগুলিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তাদের এই ধারণা স্পষ্ট শিরক’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ স্বীয় জীবদ্দশায় তাঁর সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ধম্কি প্রদান করেছেন। অথচ মৃত্যুর পর তাঁরই কাল্পনিক রূহের সম্মানে দাঁড়ানোর উদ্ভট যুক্তি ধোপে টেকে কি?

মিলাদ অনুষ্ঠানে প্রচারিত বানাওয়াট হাদীস ও গল্পসমূহ :

(১) ‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি না হ’লে আসমান-যমীন কিছু্ সৃষ্টি করতাম না’।

(২) ‘আমি আল্লাহর নূর হ’তে সৃষ্ট এবং মুমিনগণ আমার নূর হ’তে’।

(৩) ‘নূরে মুহাম্মাদী’ হ’তেই আরশ-কুরসী, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে’।

(৪) ‘আদম সৃষ্টির সত্তর হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ পাক তাঁর নূর হ’তে মুহাম্মাদের নূরকে সৃষ্টি করে আরশে মু‘আল্লায় লটকিয়ে রাখেন’।

(৫) ‘আদম সৃষ্টি হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় নক্ষত্ররূপে মুহাম্মাদের নূর অবলোকন করে মুগ্ধ হন’।

(৬) ‘মে‘রাজের সময় আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতা সহ আরশে আরোহন করতে বলেন, যাতে আরশের গৌরব বৃদ্ধি পায়’ (নাঊযুবিল্লাহ)।

(৭) রাসূলের জন্মের খবরে খুশী হয়ে আঙ্গুল উঁচু করার কারণে ও সংবাদ দানকারিণী দাসী সুওয়াইবাকে মুক্ত করার কারণে জাহান্নামে আবু লাহাবের হাতের মধ্যের দু’টি আঙ্গুল পুড়বে না। এছাড়াও প্রতি সোমবার রাসূলের (ছাঃ) জন্ম দিবসে জাহান্নামে আবু লাহাবের শাস্তি মওকূফ করা হবে বলে হযরত আববাস (রাঃ)-এর নামে প্রচলিত তাঁর কাফের অবস্থার একটি স্বপ্নের বর্ণনা।

(৮) মা আমেনার প্রসবকালে জান্নাত হ’তে বিবি মরিয়ম, বিবি আসিয়া, মা হাজেরা সকলে দুনিয়ায় নেমে এসে সবার অলক্ষ্যে ধাত্রীর কাজ করেন।

(৯) নবীর জন্ম মুহূর্তে কা‘বার প্রতিমাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, রোমের অগ্নি উপাসকদের ‘শিখা অনির্বাণ’গুলো দপ করে নিভে যায়। বাতাসের গতি, নদীর প্রবাহ, সূর্যের আলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি…।

উপরের বিষয়গুলি সবই বানাওয়াট। দেখুন : মওযূ‘আতে কাবীর প্রভৃতি। মীলাদ উদযাপনকারী ভাইদের এই সব মিথ্যা ও জাল হাদীছ বর্ণনার দুঃসাহস দেখলে শরীর শিউরে ওঠে। যেখানে আল্লাহর নবী (ছাঃ) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা হাদীছ রটনা করে, সে জাহান্নামে তার ঘর তৈরী করুক’।

তিনি আরও বলেন, لاَ تُطْرُوْنِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেভাবে নাছারাগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে।… বরং তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।

যেখানে আল্লাহপাক এরশাদ করছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছুটো না। নিশ্চয়ই তোমার কান, চোখ ও বিবেক সবকিছুকে (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৬)। সেখানে এই সব লোকেরা কেউবা জেনে শুনে কেউবা অন্যের কাছে শুনে ভিত্তিহীন সব কল্পকথা ওয়াযের নামে মিলাদের মজলিসে চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাবতেও অবাক লাগে।

‘নূরে মুহাম্মাদী’র আক্বীদা :

মূলত এই অগ্নি উপাসক ও হিন্দুদের অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদার নামান্তর। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। এরা ‘আহাদ’ ও ‘আহমাদের’ মধ্যে ‘মীমের’ পর্দা ছাড়া আর কোন পার্থক্য দেখতে পায় না। বা্উল লালনের গানের মধ্যেও এইসব কথা আছে। কথিত মা‘রেফাতী পীরদের মুরীদ হ’লে নাকি মিলাদের মজলিসে সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর জীবন্ত চেহারা দেখা যায়। এই সব কুফরী দর্শন ও আক্বীদা প্রচারের মোক্ষম সুযোগ হ’ল মিলাদের মজলিসগুলো। বর্তমানে দেশে বা এই বিলাতেও প্রায় সব ধরনের মিডিয়ায় চলছে যার জয়জয়কার। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন- আমীন!

রেফারেন্স :

[1]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (দারুল ফিকর, ১৯৮৬) পৃঃ ১৩/১৩৭।

[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[3]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৭।

[4]. আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫; নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েন-এর খুৎবা’ অধ্যায়।

[5]. আল-ইনছাফ, পৃঃ ৩২।

[6]. আবু ছাঈদ মোহাম্মাদ, মিলাদ মাহফিল (ঢাকা ১৯৬৬), পৃঃ ১৭।

[7]. মিলাদে মুহাম্মাদী পৃঃ ২৫, ২৯।

[8]. তিরমিযী, আবূদাঊদ; মিশকাত হা/৪৬৯৯ ‘আদাব’ অধ্যায়, ।

[9]. দায়লামী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২৮২।

[10]. বুখারী হা/১০৭।

[11]. বুখারী হা/৩৪৪৫।