ফেসবুকের এই হিট কমাবেন কে ?
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেলেন বুশরা আফরিন, যাঁর দায়িত্ব হবে ঢাকা শহরের তাপমাত্রাকে কমিয়ে সহনীয় অবস্থায় আনা। কাজটি জটিল এবং এ কাজে সফলতা অর্জনও বহুকিছুর সঙ্গে জড়িত। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের তৈরি করা এই পদে অধিষ্ঠিত বুশরাকে নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন রকম উদ্ভাবনী সমাধান অন্বেষণে কাজ করতে হবে।
কিছুদিন ধরে অসহনীয় গরমে থাকা এবং প্রতিবছরই নিয়মিত তাপপ্রবাহের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া ঢাকাবাসীর জন্য নিঃসন্দেহে একটি ভালো সংবাদ। অথচ এই সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলল এবং বেশির ভাগটাই নেতিবাচক কারণে।
সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হওয়ার পরই ফেসবুকে যে ধরনের আলাপ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে এই আপাত ভালো উদ্যোগের পেছনেও রাজনীতি, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিক অধিকার ও স্বজনপ্রীতিসহ আরও বহু বিষয় উঠে এসেছে। বুশরার নিয়োগ–পরবর্তী আলোচনাগুলো আমাদের সমাজপাঠের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ তুলে আনছে।
বুশরা ঢাকা উত্তরের নগরপিতা আতিকুল ইসলামের কন্যা। সংবাদমাধ্যমের খবরেও প্রথমে মনে হচ্ছিল পদটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের। স্বাভাবিকভাবেই এহেন খোলাখুলি স্বজনপ্রীতিতে নেটিজেনরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ তামাশা করেন। কেউ কেউ বুশরার পিতা যে নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র হন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটা বড় অংশের আলাপে দেখা যায়, সুন্দরী তরুণী বুশরাকে যৌন ইঙ্গিতবাহী আক্রমণে। ইংরেজি ‘হিট’–এর কাছাকাছি ‘হট’ শব্দটি মিলিয়ে বুশরাকে নিয়ে চলে আপত্তিকর সুড়সুড়িজনিত মন্তব্য ও কথাবার্তা। এমনকি ভারতের নামজাদা সংবাদপত্র আনন্দবাজারও এ থেকে পিছিয়ে নেই।
স্বজনপ্রীতি ও নাগরিক জবাবদিহি প্রদর্শনের প্রশ্ন থেকে সরে এসে কেবল নারী হওয়ায় এই আক্রমণ আমাদের সমাজে নারীর প্রতি কদর্য দৃষ্টিভঙ্গির এক বাজে উদাহরণ।
এর বিপরীতে কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদ করলেন। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ আবার স্বজনপ্রীতি কিংবা রাজনৈতিক জবাবদিহি প্রদর্শনের আলাপটা পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে চাইলেন। আর রকফেলারদের মতো ‘গরু মেরে জুতা দানের’ উন্নয়ন মডেলের আলাপ তো একেবারেই হারিয়ে গেল। সারা দুনিয়ায় পুঁজিবাদী লোভের আগ্রাসনে প্রাণপ্রকৃতি উজাড় করে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে কেবল মুনাফার খোঁজে থাকাদের ‘হিট অফিসার’ নিয়োগের দর্শন আর রাজনীতি নিয়ে কোনো আলাপই শোনা গেল না।
নারীকে আক্রমণ করার পেছনে রাজনীতি আর সমাজের অসাম্য, অসংগতির ছবিগুলো মনে না রাখলে নারীবাদের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। বুশরাকে আক্রমণ করা আর বুশরাকে মহান করে দেখিয়ে বাকি সব প্রশ্ন বাদ দিতে বলা, দুজনই দিন শেষে বুশরাকে কেবল নারী হিসেবেই দেখছেন। উভয় দৃষ্টিভঙ্গিই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ।
উত্তপ্ত দুনিয়ার মতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লড়াইটা বাস্তবের গ্রে স্কেল না মেপে সাদা আর কালোতে ভাগ হলো। নারীকে কদর্য আক্রমণ বনাম নারী মানেই ভিকটিম, এই সরল যুদ্ধে পর্যবসিত হলো।
নারী শোষকের গুটি হতে পারেন, নারী নিজেই শোষণ অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর হতে পারেন, এই আলাপ ভুলে যাওয়া নারীবাদের জন্যই বিপজ্জনক এবং নারীমুক্তির জন্য বড় অন্তরায়। নারীকে আক্রমণ করার পেছনে রাজনীতি আর সমাজের অসাম্য, অসংগতির ছবিগুলো মনে না রাখলে নারীবাদের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন।
বুশরাকে আক্রমণ করা আর বুশরাকে মহান করে দেখিয়ে বাকি সব প্রশ্ন বাদ দিতে বলা, দুজনই দিন শেষে বুশরাকে কেবল নারী হিসেবেই দেখছেন। উভয় দৃষ্টিভঙ্গিই মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ।
আমাদের সময়ে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণে নারী, রাজনীতি বা নাগরিক অধিকার নিয়ে আলাপ কমই উঠে আসছে।
বুশরা উচ্চশিক্ষিত; কিন্তু এই পদের জন্য কি তিনিই যোগ্যতম? যদি তা–ও হন, এতে কি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে না? নাকি, মেয়রের সঙ্গে বোঝাপড়ার কাজ করতে হবে বিধায় যোগ্যতা কম থাকলেও তিনিই বরং সবচেয়ে উপযুক্ত?
সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন বা রকফেলার ফাউন্ডেশন কি খোলামেলা এটি বলতে পারত না? এই পদে নিয়োগ হওয়ার ফলে বুশরার পিতার কাছ থেকে এই ফাউন্ডেশন কি সামনের দিনে বাড়তি সুবিধা পাবে?
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সামনে প্রশ্ন চলে আসে, গণমানুষের সমস্যায় জরুরি পদগুলোতে নিয়োগে জনতার কি আদৌ ভূমিকা আছে? যদি না থাকে, তবে আদৌ কি এসব পদে থাকারা জনসম্পৃক্ত হতে পারবেন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব জরুরি প্রশ্নে উত্তাল হতে পারত; কিন্তু তারা ব্যস্ত রইল অপ্রাসঙ্গিক যুদ্ধে, যাতে কদর্যভাবে ফুটে উঠল সমাজের পঙ্কিলতা, ভাবনার সীমাবদ্ধতা, এমনকি পারস্পরিক ঘৃণাও।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচানো এখন খুব জরুরি। একটাই পৃথিবী, একে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কিন্তু গরম পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিন্তার উত্তপ্ততা, ক্রমশই ঘৃণা আর অবিশ্বাসে ভাগ হয়ে যাওয়া সমাজের ‘হিট’ কমানোটাও জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই হিট কমাবেন কোন অফিসার?
-
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহ–সম্পাদক