অসমাপ্ত আত্মজীবনী: একটি জীবন্ত দলিল

অসমাপ্ত আত্মজীবনী: একটি জীবন্ত দলিল

ফারহানা মোবিন , লেখক এবং চিকিৎসক

যুগে যুগে কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। যে মানুষগুলো তাদের কর্মগুণে বেঁচে থাকা অবস্থায় হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি। এমনই বিশাল বটবৃক্ষ হলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বীর নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মমতাময়ী জগদ্বিখ্যাত নারী মাদার তেরেসা, অমর বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা, আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ।

যুগে যুগে মানুষগুলোর কর্মগুণ ও নেতৃত্ব মানুষকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করেছে। মানুষগুলোর জীবনযাপন পদ্ধতি, তাঁদের আদর্শ আমাদের জন্য হয়ে উঠেছে আলোর মশাল। বাংলাদেশের জন্য এমনই একজন আলোর মশাল হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

যে মানুষটি পৃথিবীতে জন্ম না নিলে পৃথিবীর ইতিহাসে লাল-সবুজ পতাকার জন্ম হতো না। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের দাস হয়েই থাকতাম। আমরা কোনো দিন মাথা উঁচু করে সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতাম না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে লেখাপড়া করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম তিনি।

তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হয়। এই অর্জন ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্মের জন্য অন্যতম মাইলফলক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কিংবদন্তি নেতা, একজন বড় মাপের সংগঠক, একজন সুবক্তা। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। তাঁর লেখা বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শুধু বই নয়; জাতির দিকনির্দেশনার এক জীবন্ত দলিল।

২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তাঁর পিতার লেখা চারটি খাতা এসে পৌঁছায়। খাতাগুলোর পৃষ্ঠাজুড়ে সময়ের বিবর্তনে অক্ষরগুলো প্রায়ই অস্পষ্ট, লালচে হয়ে যাওয়া পাতা। পিতার প্রিয় সন্তান শেখ হাসিনা মুহূর্তেই তাঁর পিতার হাতের লেখাগুলো চিনে ফেললেন। খাতা চারটি হাতে নিয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় আচ্ছন্ন হলেন। ছোট বোন শেখ রেহানাকে খাতাগুলো দেখালেন।

পাহাড় সমান শোক, পরিবারকে হারানের ব্যথা অশ্রুধারা হয়ে ঝরতে থাকলো দুই বোনের চোখ দিয়ে। খাতা চারটি ছিল বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনী। ১৯৬৭ সালের মাঝের দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকাকালীন তাঁর লেখা শেষ করতে পারেননি। লেখাগুলো শুধু লেখা নয়; সেসব ছিল একজন মহীরুহের প্রবল দেশপ্রেম, মানবপ্রেম আর চেতনার আলোয় আলোকিত এক প্রামাণ্যচিত্র।

যে প্রামাণ্যচিত্র লেখা হয়েছে প্রবল দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, দেশের মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য। খাতা চারটির পাতাগুলো ছিল একেবারেই জরাজীর্ণ। একটু আঘাত লাগলেই ছিড়ে যাবে এমন করুণ অবস্থা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হত্যার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে চালানো হয় গ্রেনেড হামলা। হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ মোট চব্বিশজন মারা যান। সৌভাগ্যবশত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে যান। তিনি চোখের সামনে চব্বিশজন মানুষকে হারানের শোকে কাতর হয়ে পড়েন।

দুঃখ-কষ্টের সাগরে তিনি যখন ভাসছিলেন; ঠিক তখনই চারটি খাতা তার হাতে এসে পৌঁছায়। প্রধানমন্ত্রীর এক ফুফাতো ভাই সেই চারটি খাতা তাকে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আরেক ফুফাতো ভাই হলেন শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি ছিলেন বাংলার বাণীর সম্পাদক। তার অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া গিয়েছিল সেই চারটি খাতা। ধারণা করা হয়, বঙ্গবন্ধু হয়তো লেখাগুলো টাইপ করতে দিয়েছিলেন বই প্রকাশের জন্য।

খাতা চারটির মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়, স্কুল-কলেজ, শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেশের জন্য চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশের অভাব, বিহার, কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, প্রাদেশিক মুসলীম ছাত্রলীগ ও মুসলীম লীগের রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা।

দেশভাগ হওয়ার পর থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দেশের মানুষের জীবনযাপনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল খাতাগুলোর প্রতিটি লেখাজুড়ে। খাতার পাতাগুলো এত নরম হয়ে গিয়েছিল যে, হাত দিলেই ছিড়ে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তার ছোট বোন শেখ রেহানা, সাংবাদিক বেবী মওদুদসহ আরও কয়েকজন পালাক্রমে লেখাগুলোকে খুব সাবধানে ফটোকপি করে বার বার পড়েছেন। কারণ অধিকাংশ লেখা ছিল ভীষণ ঝাপসা। কোথাও কোথাও লেখা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে লেখা উদ্ধারের কাজ করতে হয়েছিল।

খাতাগুলোর লেখা পড়তে গিয়ে অগণিতবার প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানা চোখের জলে ভাসতেন। শেখ রেহানা অসংখ্যবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। হলদে পৃষ্ঠাগুলোয় হাত বুলিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন পিতার আঙুলের স্পর্শ। বড় বোন শেখ হাসিনা বরাবরের মতোই শেখ রেহানার ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে ছোট বোনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বাবার লেখা আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে বার বার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন।

অদম্য ইচ্ছা, পিতৃপ্রেম আর দেশের মানুষকে মহান এক নেতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মহৎ ইচ্ছা থেকেই প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর লেখা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির লেখাজুড়ে প্রবল দেশপ্রেম। জেলখানায় বন্দি অবস্থায় থেকেও দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

একজন মানুষ দেশের মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবনের জন্য কতটা ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল নির্যাতন কতটা সহ্য করেছেন, মানুষের কল্যাণে নিজেকে কীভাবে বিসর্জন দিয়েছেন, লেখাগুলো সেই প্রত্যয়ের কথা-ই বলে।

বহুবিধ তথ্যে সমৃদ্ধ বইটিতে পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধীনতা, অধিকারের আন্দোলন, দেশের মানুষকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন চক্রান্তের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মতে, এই বইয়ের ঘটনাগুলোর সূত্র ধরে অনেক অজানা ঘটনার গবেষণা করা সম্ভব। খাতাগুলোয় জেলারের স্বাক্ষর দেওয়া অনুমোদনের পৃষ্ঠাগুলো অক্ষত ছিল।

তারিখগুলো দেখে ঘটনার ব্যাখ্যা, বিস্তার ও লেখার সম্পাদনার কাজে সুবিধা হয়েছিল। লেখাগুলোর সম্পাদনা, সংশোধনের কাজ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ। এরপরে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, প্রধানমন্ত্রী এবং বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা, টিকা লেখা, স্ক্যান, ছবি নির্বাচনের কাজগুলো সম্পন্ন করেন। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শেখ রেহানা।

এই খাতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালীন একান্ত নিরিবিলিতে লিখেছেন জাতির জন্য অমূল্য এক ইতিহাস। আত্মজীবনী প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই তিনি তার চারটি খাতার লেখাগুলো টাইপ করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ঘাতকদের হাতে নিহত হন। তাই বইটি আর প্রকাশ পায়নি। ভাগ্যের বিস্ময়কর খেলায় লেখাগুলো দীর্ঘবছর পরে ২০০৪ সালে এসে পৌঁছায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার হাতে।

সীমাহীন পরিশ্রম আর ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে মহামূল্য স্মৃতি কথাগুলো মুদ্রণে রূপ নেয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে জাতির হাতে পৌঁছে যায় এক চেতনার ইতিহাস, এক মহান নেতার স্বপ্নগাথা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শুধু একটি বই নয়। এটি একটি জীবন্ত দলিল। সোনার অক্ষরে মুদ্রিত মহান এক দেশপ্রেমী নেতার জীবনদর্শন। বইটি দেশ গড়ার জন্য বিরল এক দিকনিদের্শনা।